আমার প্রথম বন্ধু ধানসিঁড়ি নদী ও আমার কন্যা সন্তান রিচিতো ধানসিঁড়ি আর প্রথম ভাললাগা বনলতা সেন মিলে মিশে আছে জীবনের আনন্দ বেদনায়। আশির দশকে আমার জন্ম শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি নদীর পাড়ে- আমার দাদার বাড়িতে। যখন আমি বুঝতে শিখেছি, আমার শিশুরাজ্যে ধানসিঁড়ি’ নদী, ও একটি গোলাপজাম গাছ ছিল আমার খেলার সাথী।
আজ বিলীন হতে চলেছে ধানসিঁড়ি নদী । আর দুই যুগের অধিক সময় ধরে ধানসিঁড়ি নদীর পাশে নেই আমার বসবাস। কিন্তু হৃদয়ে অবিরত বেজে চলে তার ঢেউয়ের ধ্বনি। কর্মজীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও বরিশালে গেলে সেই ধানসিঁড়ি নদীতে ছুটে যাই। ধানসিঁড়ি নদী আর শৈশবের সেই সব স্মৃতিসুধাময় দিন তীব্রভাবে আমাকে আকর্ষণ করে, আমাকে টেনে নিয়ে যায় তার কাছে।
আমার মেয়ে দুইটি, একটি বড় মেয়ে ও অন্যটি সদ্য জন্ম নেয়া আমার কন্যা- যার নাম রিচিতো ধানসিড়ি। বন্ধুত্ববোধ ও ভালোবাসা থেকে আমার মেয়ের নাম রাখা ‘রিচিতো ধানসিড়ি।
ধানসিঁড়ি নদীর পাড়ে আমার পিতৃপুরুষের আদি বাড়িতে কেটেছে আমার শৈশব কৈশোরের ১৪টি বছর। ধানসিঁড়ি নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের শৈল্পিক সুরের মূর্ছনায় দুলে উঠতো আমার শিশুমন। রহস্যময় এক মাদকতায় ডুবে যেতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। ধানসিঁড়ি নদীতে পাল তুলে নৌকা চলতো সে সময়। মাঝিরা গান গাইতো। নদীর বুক চিড়ে ঢেউ তুলে চলমান ট্রলার, স্পিডবোর্ড ও তার গতি, যাত্রীবাহী স্টিমার ও লঞ্চ আমাকে নিদারুন ভাবে ভাবিয়ে তুলতো। ভাবতে ভাবতে আমি ডুবে যেতাম আধুনিক ও পৌরাণিক কল্পরাজ্যে…
আমার জীবনের প্রথম ‘স্লিপ ওয়াটার রাইড’ ধানসিঁড়ি নদীর চরের পিচ্ছিল কোমল মাটিতেই। আমার খেয়ালী মন এবং আমার চলমান বাস্তব জীবনে প্রথম বন্ধু ধানসিঁড়ি নদীকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক গান ও কবিতা।
গীতিকার ও কন্ঠশিল্পী আবু জাফর একটি দেশের গান লিখেছেন-
এই মধুমতি ধানসিঁড়ি নদীর তীরে
নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে।
‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ শিরোনামে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে লালনগীতি শিল্পী ফরিদা পারভিন ও আবু জাফর এর কণ্ঠে।
কবি জীবনানন্দ দাশ রূপ-লাবণ্যময় ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে লিখেছেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘আবার আসিবো ফিরে’…
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়’।
আমার জীবনের প্রথম সময়ের এক যুগের অধিক সময় ধরে ‘ধানসিঁড়ি’ নদীর তীরের মেঠো পথ ধরে নিয়মিত হেঁটেছি বহু বছর।
ধানসিঁড়ি নদীর তীরে বাঁশ ও কাঠের তৈরি ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে গ্রাম্য এক কিশোরী বধু বাস করতো, তার নাম ধাম জানি না। তিনি আজও বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। তখন আমি তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। স্কুল থেকে ফেরার পথে তার সাথে প্রথম দেখা। সেই কিশোরী বধূ শরতের খেয়ালী মেঘ আর আকাশের নিচে ধানসিঁড়ি নদীর তীরে মাতাল হাওয়ায় তার কেশ শুকোচ্ছিলেন।
মনে পড়ে আজও সেই গাঁয়ের বধুর নিস্পাপ কোমল লাবণ্যময়ী মুখমণ্ডল আর কাজলকালো মায়াভরা দুই চোখ। মাঝে মাঝে ভাবি তিনি কি সেই, কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন! তার দীঘল কালো কেশ যেন গগন থেকে নেমে সাদাটে পাহাড়ের গাল ছুঁয়ে নেমে এসেছিল এ ধরায়…
এরপরে একদিন আবারো স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার চোখে পড়ল পৈশাচিক এক ঘটনা। আমার প্রিয় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে হায়েনা রূপী এক মানুষ এক নারী চুলের মুঠি ধরে বেদম প্রহার করছে। তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই আমার দেখা রূপবতী নারী। আর নরপশুটি ছিলেন তার কলেমা পড়া স্বামী।
আমার শিশুমন সেদিন আহত হয়েছিল, খুব কেঁদেছিল আমার দুইচোখ। আমার ভেতরে থেকে কে যেন প্রশ্ন করে স্বামী মানে কি প্রভু, মালিক? সেই নারীকে আজও খুঁজে ফেরে আমার শিশুমন। কেন খুঁজি তাকে!? তার ভেতরে কি দেখেছিলাম বাংলার মাতৃরূপ!
দাদা বাড়ি থেকে চলে আসার পরে যতবার গ্রামে গিয়েছি খোঁজ করেছি তার। এক প্রতিবেশির কাছ থেকে জেনেছি, তিনি আর ইহলোকে নেই। তিনি মারা গেছেন। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি অবাক বিস্ময়ে তার কথা শুনে থমকে যাই, আমি থমকে আছি আজও, কিন্তু আমার হৃদয়ের গহীনে বেঁচে আছেন তিনি- বাংলার মা, আমার বনলতা সেন হয়ে।
এখনও আমি ধানসিঁড়ি নদীর তীরে ঘেসো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, এভাবেই বুঝি যুগ যুগ ধরে কাগজে বন্দী হয় পৃথিবীর দায়, ঘৃণা, বেদনা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা…
বসুন্ধরা
যে ঘরে প্রেম নির্যাতিত, নির্বাসিত, ধৃত,
সেখানে!
বসুন্ধরা মহামায়া কারো একার নয়
হাতে হাত, বুকে বুক, ঠোঁটে ঠোঁট
যার সাথেই হোক,
প্রেমহীন এই বাণিজ্যিক রুক্ষ ব্রহ্মান্ডে
তুই তার প্রেমিকাই হয়ে ওঠ,
থাকুক না হয় থাক কিছু ভোগ কিংবা উপভোগ,
সত্তম একটা প্রেমও না হয় হোক।
যেখানে শুয়োরের হাতে পারদের বেচাকেনা
সেই ব্রম্মান্ড নরকে প্রেম কি উত্তম না?
আরও পড়ুন…
কবি টিএম মিলজার হোসেনের কবিতা ‘মৃত্তিকা’
কবি টিএম মিলজার হোসেনের কবিতা ‘লাল রক্ত নীল খেলা’
Author
-
টি এম মিলজার হোসেন একজন বাংলা ভাষার কবি। তিনি সর্বদা ব্যতিক্রম কবিতা লিখে থাকেন, তিনি স্রোতের বিপরীতে হাঁটা মানুষ। তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু দেশ, মানুষ, মনুষ্য প্রাণী, প্রকৃতি, মানব আদর্শ, হতাশা, দাহকাল, নরক ভূমি, সমসাময়িক অস্থির সময়, মনুষ্যত্ব বোধ, অধর্ম, হিংসা ও হিংস্রতা। তার কর্মজীবন মূলত পুঁজিবাজার নিয়ে। পুঁজিবাজার তার পেশা হলেও তার অপরিসীম ভালবাসা সাহিত্যে। তিনি নরওয়ে থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা ‘সাময়িকী’র সাবেক মাল্টিমিডিয়া সম্পাদক। বর্তমানে ‘ঢাকা শেয়ার বাজার ডট কম’ এর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
View all posts
একটি রেসপন্স