ঢাকা শেয়ার বাজার

৮ নভেম্বর ২০২৫ শনিবার ২৩ কার্তিক ১৪৩২

বৈশাখী মেলা এবং আমার কৈশোর বেলার স্মৃতি

সবার আগে শেয়ার বাজারের নির্ভর যোগ্য খবর পেতে আপনার ফেসবুক থেকে  “ঢাকা শেয়ার বাজার ডট কম” ফেসবুক পেজে লাইক করে রাখুন, সবার আগে আপনার ওয়ালে দেখতে। লাইক করতে লিংকে ক্লিক করুন  facebook.com/dhakasharebazar2024

বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনা’রা হেঁটে যায়- এই গানটি প্রথম শুনেছিলাম ১৪০২ বঙ্গাব্দের (১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ) পহেলা বৈশাখের দিনে। সে সময়ে আমার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। আমি ভীষণ রকম অনুভব করতে শুরু করলাম অভূতপূর্ব আনন্দ উচ্ছাসের বাঙালি জীবন ও তার বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। আমাদের আশেপাশে থাকা মানুষের জীবনের আনন্দ-উচ্ছাস।

ছোটবেলা থেকে সবার মত আমি ও অপেক্ষা করতাম ১লা বৈশাখের। পহেলা বৈশাখ ছিল আমার জীবনের অন্যতম একটি আনন্দের দিন। ঐ দিন সকাল থেকে প্রায় সবার বাড়িতে হতো বিশেষ ভোজ উৎসব আয়োজন। পহেলা বৈশাখ মানেই নতুন পোশাক, বিশেষত পাঞ্জাবী উপহার পেতাম পরিবার থেকে।

রান্নাবান্নার বিশেষ রকমের আয়োজন হতো আমাদের বাড়িতেও। বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি, ফলমূল সহ আপ্যায়ন করা হতো বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে আসা অথিতিদের। সকাল থেকেই থৌল খরচ পেতাম বাড়ির বড়দের কাছ থেকে। থৌল নামে মেলা। আমাদের গ্রামে মেলাকে থৌল বলা হতো। মেলা হলো একটি স্থানে অনেক মানুষ একত্রিত হওয়া। বৈশাখী মেলার সঙ্গে আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড়। বাংলার এই সংস্কৃতিতে থাকে সব ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয়। শহর কিংবা গ্রামের কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় মেলার। পহেলা বৈশাখের এই মেলাকে ঘিরেই যেন আমাদের প্রানচাঞ্চল্য। বিকেলে মহা আনন্দের মুল আকর্ষণ বৈশাখী মেলা ও নাগরদোলা। আর সারা দিন নিজের অজান্তেই মুখের বুলি থাকতো ফিডব্যাক ব্যান্ডের মেলা অ্যালবামের মাকসুদুল হকে লেখা ও গাওয়া “মেলায় যাইরে’
লেগেছে বাঙালীর ঘরে ঘরে
একি মাতনদোলা
লেগেছে সুরেরই তালে তালে
হৃদয় মাতনদোলা
মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে…

এর পরের লাইন গুলি আমার মুখস্ত ছিলনা, তাই প্রথম চার লাইনের পরই আমি আনন্দে সাথে গাইতাম “মেলায় যাইরে” লাইনটি বারবার গাইতাম। আর তখন বেতারের যুগ, সারা দিন বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন সেন্টারে একটা গানই ঘুরে ফিরে বাজতো – মেলায় যাইরে।

পহেলা বৈশাখের সকালটা শুরু হতো মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আমার দাদীমার শেখানো পদ্ধতিতে বিশেষ এক ধরেনের সবজির ঝোল রান্না হয়ে এসেছে সেই থেকেই পরিবারে। সাথে বিভিন্ন ধরণের ভর্তা, পান্তা ভাত, ডিম ভাজা আর ইলিস ভুনা, ভাজা। এর পর এলাকা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ। প্রতিবেশীদের সাথে সাধ্য মত অভূতপূর্ব আনন্দ উচ্ছাসের সাথে ভোজ উৎসব চলতো মধ্যাহ্ন ভোজ অব্দি। দুপর হতে, শেষ দুপুরে মনে মনে সুর বাজে হালখাতা।

আমার ছোট বেলায় বিশেষ একটা ঐতিহ্য ছিল, আমাদের দেশে যার নাম “হালখাতা”। সে সময় হালখাতা শব্দের মানে বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম নববর্ষের দিনে বিনে পয়সায় দোকানে দোকানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। সকাল দশটা থেকে দুপুর পর্যন্ত আমিও অন্যান্যদের সঙ্গে দোকানগুলোতে যেতাম। দোকানীরা আমাদের রসগোল্লা, বাতাসা, আমিরত্তি, মুড়িমুড়কি, চিনির সন্দেশ, দানাদার, জিলাপিসহ অনেক ধরণের মিষ্টি খাবার খেতে দিত। সেগুলো সব খেতে না পারলেও পকেটে কিংবা খবরের কাগজে মুড়ে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। এরপরে ভাইবোনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে সে মিষ্টিগুলো খেতাম।

পুরানো বছরের সমস্ত লেনদেন সমাপ্তি হতো পহেলা বৈশাখে সব ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মাঝে। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কেন্দ্র এই দিন সাজসজ্জা হতো বেশি রঙ্গিন করে। তখন এই উপলক্ষে হালখাতায় লেনদেন শেষে রসগোল্লা, আমৃত্তি, জিলাপি, মুড়িমুড়কি, বাতাসা খাওয়ানো হতো। ছোট বেলায় আমার অন্যান্য ভাইবোনদের সাথে হালখাতায় মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারটা আমার সহ প্রায় সবার কাছেই ভীষণ উপভোগ্য ছিল। আমাদের কোন ভাই বা বোন না গেলে তাঁর জন্য কাগজের ঠোঙ্গায় ভরে তাঁদের জন্য পাঠিয়ে দিত বাড়িতে দোকানীরা। পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা উপলক্ষে জন্য আমরা পাড়া মহল্লায় আনন্দের সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াতাম। হালখাতা শেষ করে ছুটতাম মুল আকর্ষণ বৈশাখী মেলার মাঠে। মেলায় যাইরে….. চূড়ান্ত আনন্দ।

দুপুর শেষ হতেই মুল আকর্ষণ বিকেলের শুরুতেই আমার প্রথম উপভোগ্য ঐতিহ্যবাহী প্রেম “বৈশাখি মেলা”। মেলায় গিয়ে প্রথমেই আমরা নাগরদোলায় চড়তাম, ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় উপভোগ করতাম। সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখতাম। সবাই সবার সাথে খুনসুটি করতাম। মাটির বানানো বিভিন্ন শিল্পকর্ম কিনতাম সাথে টাকা জমানোর নতুন মাটির ভাঁড় (ব্যাংক), ভাঁড় কেনার অভ্যাস টা আমার এখনও আছে, ঠিক আগেরই মতোই। মেলায় যাবার জন্য পরিবার থেকে ৫/১০ টাকা করে পেতাম। সাথে পূর্বের মাটির ভাঁড়ে (ব্যাংক) জমানোর পয়সা থাকতো। যেটা কিনা গতকাল রাতেই ভাগা হয়েছে, যেহেতু বিশেষ দিন ও বিশেষ মেলা।

সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত হতো মেলায় ঘোরাঘুরি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে শেষ বিকেলে বাউল গান উপভোগ করার সুযোগ হতো। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরার সময় বৈশাখী মেলা হতে কেনা হতো ১/২ টা হাওয়াই মিঠাই। যে হাওয়াই মিঠাই খেতাম আমরা ৪/৫ জন মিলে। হাওয়াই মিঠাই খেতে খেতে বাড়ি ফেরার পালা।

আমরা বাঙালি, আমরা আমাদের ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধশালী ইতিহাস জানার ব্যাপারে অতটা আগ্রহী নই। কিভাবে আমাদের বাংলা নববর্ষ এবং বাংলা ক্যালেন্ডার পেলাম জানতাম না শৈশবে কিছুই। যদিও বড়দের মুখেও কখনো এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শুনিনি। তবে প্রতিটি বাঙালি পরিবারে পহেলা বৈশাখ পালন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তখন কেউ ভাবতো না যে নববর্ষ পালন করা উচিত কি উচিত নয়!

সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উৎযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেক কে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের (চৈত্র সংক্রান্তি) মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত গ্রাম অঞ্চলে, পুরান ঢাকায় কিছু অংশে, গ্রাম অঞ্চলের স্বর্ণের দোকানে।

‘মেলার’ আক্ষরিক অর্থ ‘মিলন’। বৈশাখী মেলা মূলত সার্বজনীন লোকজ মেলা। মেলার মানেই বাঙালির এক অভূতপূর্ব আনন্দ উল্লাস, নেচে গেয়ে ওঠে আমাদের মন। ছোট বেলার মেলায় আনন্দ, মেলার ছবি আমার মনে আজও অঙ্কিত। চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই সেই আনন্দ উচ্ছাস।

আজও মেলা আমাকে আনন্দিত করে পূর্বের ন্যায়, যদিও বদলে গেছে অনেক কিছু। আনন্দের অনুভূতি ও অন্যরকম। পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। নববর্ষের উৎসব এক সময় বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল। ফলে শহর ও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখি মেলা ও নানান সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।

আনন্দের বিষয় জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ”মঙ্গল শোভাযাত্রা”কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

১৪০২ বঙ্গাব্দ (ইংরেজি ১৯৯৫ সাল) হতে ১৪৩২ বঙ্গাব্দ (ইংরেজি ২০২৫ সাল) সেই সময় সেই পরিবেশ আজ আর নেই। কমেছে মানুষের মানবিকতা, মানুষের স্বজন সুসম্পর্ক, আন্তরিকতা, অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা, স্বজনদের মধ্যে পারিবারিক যাতায়াত অনেক কমে যাচ্ছে।

বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে হিংসাত্মক উস্কানি, মানব মনের হিংস্রতা বেড়েছে। দেশ আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক উন্নত হয়েছে। কয়েক বছর আগে পহেলা বৈশাখের রমনার বটমূলে বর্ষবরণের প্রভাতী অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে মানুষ মেরেছে কিছু উগ্রবাদী অমানুষ। বাংলা ১৪২৯ বঙ্গাব্দের শেষে ১৪৩০ নববর্ষের আগে ভীতি ছড়ানোর জন্য কিছু উগ্র, মানহীন, অমানুষ মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দিয়ে চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে যে চিরকুট পাঠানো হয়েছে।

তাছাড়াও কিছু উগ্রবাদী মানুষ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আজ আহত মনে, এভাবে কবিতার মতো করে বলতে চাই –
দাহ সময়ে এসো, এসো বৈশাখ এসো,
সাথে এসো কাল বৈশাখী,
জীবনের সন্ধ্যা উড়িয়ে নাও, করে দাও বিলীন,
সাথে সমাজের নষ্ট যত জন-জঞ্জাল ও অচ্ছুত।
জীবনকে রাঙ্গিয়ে আবার করো
অসাম্প্রদায়িক, অকৃত্রিম, মানবিক, অর্থবহ ও রঙ্গিন।
বৈশাখী ঝড়ে উড়িয়ে ধুয়ে মুছে
ঝড়ো বৃষ্টি করো নতুন সুসৃষ্টি।

পৃথিবী ব্যাপী অস্থির এই দুঃসময়ে, শান্তি ফিরে আসুক মানুষের কর্মেই। মানুষের মানবিক, যৌক্তিক জীবন, অকৃত্রিম জীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা এই নববর্ষে। আনন্দে কাটুক জীবন।
।। শুভ নববর্ষ ।।

Author

  • টি এম মিলজার হোসেন একজন বাংলা ভাষার কবি। তিনি সর্বদা ব্যতিক্রম কবিতা লিখে থাকেন, তিনি স্রোতের বিপরীতে হাঁটা মানুষ। তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু দেশ, মানুষ, মনুষ্য প্রাণী, প্রকৃতি, মানব আদর্শ, হতাশা, দাহকাল, নরক ভূমি, সমসাময়িক অস্থির সময়, মনুষ্যত্ব বোধ, অধর্ম, হিংসা ও হিংস্রতা। তার কর্মজীবন মূলত পুঁজিবাজার নিয়ে। পুঁজিবাজার তার পেশা হলেও তার অপরিসীম ভালবাসা সাহিত্যে। তিনি নরওয়ে থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা ‘সাময়িকী’র সাবেক মাল্টিমিডিয়া সম্পাদক। বর্তমানে  ‘ঢাকা শেয়ার বাজার ডট কম’ এর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

    View all posts
Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
আপনি এটাও পড়তে পারেন
শেয়ার বাজার

আপনি এই পৃষ্ঠার কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না।