আজ মহান মে দিবস। বিশ্বে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মে দিবস এক স্মরণীয় অধ্যায়। আজ বিশ্বের ৮০টি দেশে অগণিত শ্রমিকের পায়ে হেঁটে মিছিলে অগ্নিঝরা শ্লোগান আপসহীন সংগ্রামের কথা বলে। দেশের সড়কগুলো বিভিন্ন রঙের আলোকসজ্জায় সাজে। ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড দ্বারা সজ্জিত হয় পথের দুই ধার।
আজ পৃথিবীর সকল মেহনতি মানুষের এক হয়ে ব্রত নেবার দিন।
১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করত। ‘হে মার্কেটে’র শ্রমিকরা কাজের সময় ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা আর উপযুক্ত মজুরি আদায়ের দাবি নিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবি মেনে নেয় না। ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন।
তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশবাহিনী তৎক্ষণাৎ শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা রায়টের রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহিদ হন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়।
এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্য একজনের পনেরো বছরের কারাদণ্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহণের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন, এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি। তবে পয়লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের উৎপত্তি হলেও আমেরিকায় কিন্তু শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’।
আজ বিশ্ব জুড়ে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা হ্রাস এবং তাদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনমুখর একটি ঐতিহাসিক দিন শ্রমিক সংহতি দিবস বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটির দিন। এই উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দিনটি পালন করতে শোভাযাত্রা, শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সহ নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। এছাড়াও মে দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশন-সহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালন করে।
বাংলাদেশে ১৯৭২সালে মে দিবস পালিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সে দিন তিনি পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বাংলার মেহনতি মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষক ছাত্র যুবক যারা সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের জুলুম এবং ঔপনিবেশিক জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতার ইতিহাস লিখে গেলেন, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন ভুলবে না। তারা আর কোনো দিন আমাদের কাছে কোনো দাবিদাওয়া নিয়ে আসবেন না। কিন্তু এই লাখ লাখ শহিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, এ দেশের ইতিহাসে। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষ দেশ গড়ার সংগ্রামে। তাদের কাছ থেকে পাবে প্রেরণা। তাই আজকের এই মহান দিনে আমার দেশের শ্রমজীবী মানুষদের আমি শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যে বলিষ্ঠ ভূমিকায় নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আজ জাতির পিতা আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন একটি দেশ, একটি পতাকা। দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন ও আদর্শ।
আজ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের উৎসবের দিনে আমরা সকলে সকলে মিলে জাগরণের গান গাই। পুঁজিবাদী শােষণ থেকে মুক্তির জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই এবং মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ সোনার বাংলাদেশ গড়তে দৃপ্ত শপথ নেই।