কেবল পুষ্টিকর খাদ্য জোগাড় করলেই হবে না; যদি সঠিক পদ্ধতিতে রান্না না হয়, তবে খাদ্যের মূল্যবান পুষ্টি তো নষ্ট হবেই। এমনকি তা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অধিকাংশ বাঙালী পরিবার যে পদ্ধতিতে রান্নাবান্না করে তাতে খাদ্যের পুষ্টিমান অর্ধেকও অবশিষ্ট থাকে না। অন্যদিকে খাবারের রাসায়নিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে টক্সিক কেমিক্যাল ফর্ম করে, যা আমাদের দেহে বিভিন্ন জটিল রোগব্যাধি সৃষ্টি করে। সময় এসেছে এ ব্যাপারে সচেতন হবার। যারা রান্নার সাথে জড়িত, তাদের এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞানের প্রয়োজন আছে।
আমরা সচারাচর রান্নাবান্নায় যে ভুলগুলো করি, তা নিম্নে আলোকপাত করা হল :
১. শাক–সবজি কাটাকুটি ও ধোয়া : আমরা সাধারণত শাকসবজির খোসা ছাড়িয়ে কেটে ছোট ছোট টুকরো করে পানিতে বারবার ধুই। এতে পানিতে দ্রবীভূত ভিটামিনের (বি ও সি) বেশ খানিকটা বের হয়ে যায়। এতে প্রায় ৪০% পুষ্টিগুণ হারিয়ে যায়। বরং বাজার থেকে শাকসবজি কিনে সরাসরি লেবু রস বা লবণ মিশ্রিত পানিতে প্রায় ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এতে ব্যবহৃত কীটনাশক বা ক্ষতিকর কেমিক্যাল এর সিংহভাগ দূর হয়ে যাবে। ভাল করে ধোয়ার পর খোসা ছাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত বড় টুকরো করে কাটুন। কিন্তু শাকসবজি কাটার পর আর ধোয়া যাবে না, তা সরাসরি রান্নায় চড়িয়ে দিন।
২. সিদ্ধ করার পর পানি ফেলে দেয়া : এই বড় ভুলটা আমরা প্রায়ই করে থাকি। শাক সবজি সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিলে ভিটামিন–বি, ভিটামিন–সি ও খনিজ লবনের ৬০–৭০% পানির সাথে বেরিয়ে যাবে। বরং প্রথমেই পরিমিত পানি ব্যবহার করুন এবং শাক সবজি কখনো রান্না করে শুকনো করবেন না। অনেকেই ভাতের মাড় ফেলে দেয় – যা খুবই খারাপ অভ্যাস।
৩. খালি পাত্রে তেল উত্তপ্ত করা : অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কোন রান্নার শুরুতে খালি কড়াই বা পাত্রে তেল দেয়ার পর অতি উত্তপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মাছ– মাংস বা সবজি দেই না। প্রতিটি তেলের নির্দিষ্ট স্মোক পয়েন্ট (smoke point) থাকে, অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় তেল ভেঙে গিয়ে ধোঁয়া ওঠে। এর ফলে তেলে রাসায়নিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে টক্সিক হয়ে যায়। এই বিষাক্ত তেল খেলে আমাদের অন্ত্র, লিভার, হার্ট, কিডনি ইত্যাদি অর্গানে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, এমনকি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ হতে পারে। তাছাড়া এই অতি উত্তপ্ত তেলে যে খাদ্যরান্না হবে তার পুষ্টিমানও নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই কড়াই গরম করে তারপর তেল দিন। ধোঁয়া বের হওয়ার আগেই ফোড়ন, মাছ বা সবজি দিয়ে ঢেকে দিন। ক্ষতিকর ধোঁয়ার হাত থেকে শরীর বাঁচবে, পুষ্টিও থাকবে অটুট।
৪. ডুবো তেলে ডিপফ্রাই : আমরা প্রায়ই অতি স্বাদের জন্য ডুবো তেলে কড়া ভাঁজা করি। কিন্তু এতে খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায় এবং বিষাক্ত কেমিক্যাল সৃষ্টি হয়। অতি উত্তাপের ফলে তেলও খাবার অক্সিডাইজড ও টক্সিক হয়ে যায় – যা শরীরে ইনফ্লেমেশন সৃষ্টি করে। এতে আপনি খাবারের পুষ্টি তো পাচ্ছেনই না, উল্টো শরীরে প্রদাহজনিত জটিল দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করছেন।
৫. এক তেলে বারবার রান্না করা : অনেকেই ডুবো তেলে ভাজার পর অবশিষ্ট তেল দিয়ে অন্য খাবার রান্না করে। তেলকে বারবার রিসাইক্লিং হিট করলে তেল হতে ক্ষতিকর টক্সিন পদার্থসৃষ্টি হয়, যা ক্যান্সারসহ অনেক জটিল রোগের কারণ। সুতরাং কোন রান্নার পর যদি কড়াইয়ে কোন তেল অবশিষ্ট থাকে তা অবশ্যই ফেলে দিতে হবে।
৬. রান্না খাবার ফ্রিজে রেখে আবার গরম করা : রান্না করা খাবার ফ্রিজে রেখে আবার গরম করে খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত না। রিপিটেড হিটিং খাদ্যে বিষাক্ত পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে – যাস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
৭. অস্বাস্থ্যকর হাঁড়ি পাতিল : রান্নার জন্য এলুমিনিয়াম, নন–স্টিক, কাঁসা ইত্যাদি ক্ষতিকর হাঁড়িপাতিল ব্যবহার করলে খাবার পুষ্টি নষ্ট হয় এবং খাবারের সাথে বিষাক্ত কেমিক্যাল যুক্ত হয়। পরিবর্তে কাস্ট আয়রন, কাঁচ, সিরামিক, পোড়া মাটি কিম্বা স্টিলের হাঁড়ি পাতিল ব্যবহার করুন।
৮. অতি তাপে অধিক সময় রান্না করা : অতি তাপে বেশি সময় নিয়ে রান্না করলে শাক সবজিসহ অনেক খাদ্যের পুষ্টিমান নষ্ট হয়ে যায়।
৯. গ্রিল করে খাওয়া : মাছ–মাংস গ্রিল করলে কিছু অংশ পুড়ে গিয়ে পুষ্টিমান নষ্ট হয়ে যায়।
১০. মাইক্রোওভেন ব্যবহার : অনেকের ধারণা মাইক্রোওভেন খাবারের পুষ্টিমান ঠিক রাখে।কিন্তু মাইক্রোওভেন ক্ষতিকর রেডিয়েশন সৃষ্টি করে খাবারের কেমিক্যাল স্ট্রাকচার নষ্ট করতেপারে।
এছাড়া নিম্নের টুকিটাকি টিপস্ ফলো করতে পারেন –
রান্নার সময় যথাসম্ভব পাত্র ঢেকে রাখুন।
এক রান্না শেষে পাত্র না ধুয়ে অন্য রান্না করবেন না।
কড়াই বা পাত্র অতিরিক্ত ভর্তি করবেন না।
অনেক সবজির খোসা সবজির চেয়েও পুষ্টিকর। এগুলোর খোসা ছাড়ানোর দরকার নেই।
নিজে সচেতন হন এবং যারা রান্নার সাথে জড়িত তাদেরকেও এই বিষয়গুলি জানান।
লিখেছেন
ইঞ্জিনিয়ার সফিকুল ইসলাম