পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চামড়া খাতের কোম্পানি লিগ্যাসি ফুটওয়্যার লিমিটেড (LEGACYFOOT)কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। কোম্পানিটির বাজারে মোট শেয়ার রয়েছে ১ কোটি ৩০ লাক্ষ ৭৯ হাজার ৯৮০ টি।২০২১ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, শেয়ারবাজারের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকার কম থাকতে পারবে না। সেই নির্দেশনা পরিপালনে নতুন শেয়ার ইস্যু করে মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় লিগেসি ফুটওয়্যার লিমিটেড । লিগেসি ফুটওয়্যারের এ উদ্যোগ ছিল অভিনব কায়দায়।এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্যেই ছিল মালিক পক্ষের লাভ হওয়া।
সাধারণত প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধির কয়েকটি উপায় আছে। এর মধ্যে রয়েছে রাইট শেয়ার ইস্যু, পুনঃ প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা রিপিট আইপিও বা প্রাইভেট প্লেসমেন্ট ব্যবস্থা। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রাইট শেয়ার ও রিপিট আইপিওর ক্ষেত্রে সব সমস্ত শেয়ারধারীর বিপরীতে সমানুপাতিক শেয়ার ইস্যু করতে হয়। এর বাইরে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে পছন্দের লোকের বিপরীতে নতুন শেয়ার ইস্যু করেও মূলধন বাড়ানো যায়। লিগেসি ফুটওয়্যার লিমিটেড (LEGACYFOOT) কোম্পানিটি নিজেদের সার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শেষের পথটি বেছে নেয়। কোম্পানিটি মোট ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন করে ৩ কোটি শেয়ার ছেড়ে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। যার মধ্যে কোম্পানির তিনজন উদ্যোক্তা-পরিচালক রয়েছেন। বাকি ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কোম্পানির কাছের লোকজন।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য বাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে ১১৫ টাকার উপরে লেনদেন হবার সময় প্লেসমেন্টে প্রতিটি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে মাত্র ১০ টাকা ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্যে।এই খবরে আতংকিত হয়ে গত ৩ দিনে কোম্পানিটি দাম হারিয়েছে ২০ শতাংশ। গতকাল ১৪ ই সেপ্টেম্বর কোম্পানির ক্লোজিং দাম ৯৪.৯০ টাকা অনুযায়ী, ৩ কোটি প্লেসমেন্ট শেয়ারের বাজারমূল্য হবে ২৮৪.৪৭ কোটি টাকা। কিন্তু ২৮৪.৪৭ কোটি টাকার শেয়ার ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে মাত্র ৩০ কোটি টাকার বিনিময়ে। গতকাল ১৪ ই সেপ্টেম্বর কোম্পানির ক্লোজিং দাম অনুযায়ী উক্ত ১৭ জন বিনিয়োগকারীর ৩০ কোটি টাকার শেয়ারের দাম গিয়ে দাড়াবে ২৫৪.৭০ কোটি টাকা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত লিগ্যাসি ফুটওয়্যার লিমিটেড (LEGACYFOOT)
কোম্পানিটিকে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত কেন দেওয়া হল বিষয় টি একজন সাংবাদিক জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কোম্পানিটি লোকসানি একটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাভাবে ব্যবসা চালাতে পারছিল না। আইনি শর্ত মেনে রাইট শেয়ার বা রিপিট আইপিওর মাধ্যমে নতুন শেয়ার ছাড়াও সম্ভব হচ্ছিল না। আবার ঋণ খেলাপি হওয়ায় নতুন করে ব্যাংকঋণও পাচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটি অর্থের সংস্থান করতে প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়। আইনি শর্ত পরিপালন করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেটির অনুমোদন দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল লোকসানি কোম্পানিটি যদি ব্যবসায় ফিরতে পারে, তাতে বিনিয়োগকারীরাই লাভবান হবেন।
কিন্তু বাস্তবে বিনিয়োগকারীদের যদি লাভ চাইত তাহলে তাদের উচিৎ ছিল রাইট শেয়ার দেয়ার নিয়ম শিথিল করে সব বিনিয়োগকারীদের হিস্যা অনুযায়ী রাইট শেয়ার অনুমোদন করা।
প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যুর সিন্ধান্ত টি কোন ভাবেই বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে হয়নি,সার্বিক দিক বিবেচনায় বিনিয়োগকারীরা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ক্ষতির সম্মুক্ষিন হবেন।
উল্লেখ্য ৭ সেপ্টেম্বর লিগেসি ফুটওয়্যার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানায়, কোম্পানিটি রূপালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখা থেকে তাদের প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে প্রায় ২০ কোটি টাকার সুদ মওকুফের সুবিধা পেয়েছে। এখন সাড়ে ১১ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেই কোম্পানিটির ব্যাংকঋণের দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।লিগেসি ফুটওয়্যার দীর্ঘদিন ধরে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক ছিল। খেলাপি গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এককালীন পরিশোধের শর্তে সুদ মওকুফের বিশেষ সুবিধা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। লিগেসি ফুটওয়্যারের আবেদনের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংক এককালীন অর্থ পরিশোধের শর্তে ২০ কোটি টাকার বেশি সুদ মওকুফ করে। জানা গেছে, লিগেসি ফুটওয়্যার প্লেসমেন্টে তাদের পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে মূলধন সংগ্রহ করছে, তা থেকে ঋণের বাকি অর্থ পরিশোধ করবে। বাকি অর্থ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সুদ মওকুফের আনুষ্ঠানিক তথ্য ডিএসইর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানানোর আগে এ-সংক্রান্ত তথ্য বাজারে গুজব ঘুরছিল, যা কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কারসাজিকারকেরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। শেয়ারবাজারে এ ধরনের খবর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব তথ্য আগাম জেনে কারসাজিকারকেরা সাধারণত শেয়ারের দাম বাড়ানোর কাজে লাগান। অনেক সময় কোম্পানির উদ্যোক্তারাও আড়ালে থেকে শেয়ারের দাম বাড়ানোর স্বার্থে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকেন।কোম্পানিগুলির ইনসাইড নিউজ গুলো প্রকাশ করে ফায়দা নিচ্ছেন কারসাজি চক্র।
প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত এবং ব্যাংকের সুদ মৌকুপ ইত্যাদি বিষয় গুলি যেন সাজানো গুছানো ছিল।শেয়ারটি যখন ফ্লোরে ছিল তখন থেকে ফেসবুক ও গুলশান ,মতিঝিলের শেয়ার বাজারের আড্ডায় এই বিষয় টি প্রচার হচ্ছিল।
প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যু করার আইনি সুযোগ থাকলেও সাধারণত তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যুর বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ, তাতে গুটিকয় লোকের লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর স্বার্থহানি হয়। কিন্তু বিএসইসি দুর্বল মানের লোকসানি এ কোম্পানিকে বিশেষ আইনি সুবিধা দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উপকার না করে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতি করেছে।
প্রাইভেট প্লেসমেন্টে লিগেসি ফুটওয়্যারের শেয়ার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক। এ ছাড়া কোম্পানিটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এঁদের মধ্যে কাজী রাফি আহমেদ কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাজারসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ধারণা, উল্লিখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং লিগ্যাসি ফুটওয়্যার লিমিটেড এর মালিক পক্ষের কাছের লোকজন।
প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যু করার ফলে কোম্পানিটির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। যেমন , সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারমূল্যে কোম্পানিটির শেয়ার কিনলেও গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ১০ টাকা মূল্যে ৩ কোটি শেয়ার ইস্যু করা হচ্ছে। তারা এসব শেয়ার বিক্রি করে পরবর্তী সময়ে বেশি লাভবান হবেন। যদিও প্লেসমেন্টে ইস্যু করা শেয়ারে ন্যূনতম এক বছরের বিক্রয় নিষেধাজ্ঞা বা লকইন থাকছে।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন দাম সমন্বয়ের কারণে। নিয়ম অনুযায়ী, যখন কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিদ্যমান শেয়ারের বাইরে নতুন শেয়ার ইস্যু করে, তখন সেই অনুপাত বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য সমন্বয় হয়। তাতে শেয়ারের বাজারমূল্য কমে যায়।
আমরা যদি ২৭ সেপ্টেম্বর কোম্পানির রেকর্ড তারিখে ১০০ টাকা ক্লোজিং দাম ধরে হিসাব করি , তাহলে দেখা যাবে মূল্য সমন্বয় এর পরে শেয়ারটির দাম কমে গিয়ে দাড়াবে ৩৪ টাকার মতো। সাধারণত রেকর্ড তারিখের পর দাম সমন্বয় করা হয় একথা আমরা জানি।তাহলে বিএসইসি বিষয় টি জেনেও বিনিয়োগকারীদের এমন ক্ষতি মুখে কেন ফেলে দিল প্রশ্ন আপামর শেয়ার রিলেটেড লোকজনের।
প্লেসমেন্টের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যু করার বিয়টি নিয়ে বিএসইসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোম্পানিটিকে যে সুবিধা দিয়েছে, তাতে লাভবান হবে ১৭ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আইনে থাকলেও একটি কোম্পানিকে লাভবান করাতে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া অন্যায়। আবার যে দামে কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নতুন শেয়ার ইস্যুর সুযোগ দেওয়া হয়েছে, বাজারমূল্যের বিবেচনায় সেটিও ঠিক হয়নি। এর মাধ্যমে বিদ্যমান শেয়ারধারীদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।
আইনে সুযোগ থাকলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় এমন কোনো সুযোগ কাউকে দেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনোভাবেই উচিত নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
লিগ্যাসির প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর ফলে কারো পৌষমাস কারো সর্বনাশ
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাঁদের কাছে শেয়ার টি আছে , তাঁরা নতুন করে ইস্যু করা শেয়ার পাবেন না। কিন্তু প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন শেয়ার ইস্যু করার ফলে বাজারমূল্য সমন্বয় হলে তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর্থিকভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ,বিষয়টি কি করতৃপক্ষ হিসাবে নেননি।এই প্লেসমেন্ট ইস্যুর ফলে বিনিয়োগকারীরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে , কর্তৃপক্ষ তার দায় এড়াতে পারবেনা কোন ভাবেই।

কর্তৃপক্ষের উচিৎ আপামর বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনায় রেখে ৩ কোটি শেয়ার ইস্যুর বিষয়টি নিয়ে ভাবা।এত বড় একটি সিদ্ধান্ত মাত্র ১০ দিনের নোটিশে রেকর্ড তারিখ দেয়া ঠিক হবেনা।গত ৬ মাস যাবৎ শেয়ারটির দামের রেঞ্জ ৭০-১৪০ টাকা।গত ২৫ মের পর থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ,২০২৩ তারিখ পর্যন্ত মোট ৭৫ দিন শেয়ারটি ১০০ টাকার উপরে লেনদেন হচ্ছে।এই মুহুর্তে ৩ কোটি শেয়ার সমন্বয় করলে বর্তমান বিনিয়োগকারীদের ঠকানো হবে।যেহেতু ৩ কোটি প্লেসমেন্ট শেয়ারের লকইন প্রিয়ড ১ বছর তাই রেকর্ড তারিখ লক ফ্রি হবার আগে রেকর্ড তারিখ দিলে বিনিয়োগকারীরা অন্তত বড় লসের হাত থেকে বাঁচতে সময় পেত।বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন আশা করি।